শুক্রবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২১

প্রেমিক - জয় গোস্বামী

 

প্রেমিক

জ য় গো স্বা মী

তুমি আমাকে মেঘ ডাকবার যে বইটা দিয়েছিলে একদিন
আজ খুলতেই দেখি তার মধ্যে এক কোমর জল।
পরের পাতায় গিয়ে সে এক নদীর অংশ হয়ে দূরে বেঁকে
গেছে।

আমাকে তুমি উদ্ভিদ ভরা যে বইটা দিয়েছিলে
আজ সেখানে এক পা-ও এগোনো যাচ্ছে না, এত জঙ্গল।
গাছগুলো এত বড় হয়েছে যে মাটিতে আলো আসতে
দিচ্ছে না।

তুমি আমাকে ঝর্ণা শেখবার যে বইটা দিয়েছিলে
আজ সেখানে মস্ত এক জলপ্রপাত লাফিয়ে পড়ছে
সারাদিন।

এমনকি তোমার দেওয়া পেজ-মার্কের সাদা পালকটাও
যে বইতে রেখেছিলাম, সেখানে আজ
কত সব পাখি উড়ছে, বসছে, সাঁতার কাটছে।
তোমার দেওয়া সব বই এখন মরুভূমি আর পর্বতমালা,
সব বই আজ সূর্য, সব বই দিগন্ত …

অথচ আজকেই যে আমার লাইব্রেরি দেখতে আসছে বন্ধুরা
আমার পড়াশোনা আছে কিনা জানার জন্য! তাদের আমি
কী দেখাবো? তাদের সামনে কোন মুখে দাঁড়াবো আমি!

রবিবার, ৫ জুলাই, ২০২০

তোমার বিষাদগুলি – পুর্ণেন্দু পত্রী

তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে দাও
ওষ্ঠপুটে রাখি।

ভীষণ বৃষ্টির শব্দ সারাদিন স্মৃতির ভিতরে।
একাকিনী বসে আছ বৃষ্টির ভিতরে
বালুকাবেলায়
কবেকার উইয়ে-খাওয়া ছবি।
তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে দাও
ওষ্ঠপুটে রাখি।

মানুষের ভীষণ বিষাদ
একদিন বেজেছে মন্দিরে শঙ্খ-ঘন্টা রবে।
মানুষের মহান বিষাদ
ভাষ্কর্যখচিত স্তম্ভে একদিন ছুঁয়েছে আকাশ।
আজ ভীষণ নীরব।

জলের ভিতরে ছুরি ঢুকে গেলে
আর্তনাদহীন।

রক্তের ভিতরে কান্না ঢুকে গেলে
প্রতিবাদহীন।

যে যার উদ্যানে ছায়াতলে
পুষ্পের ভিতরে অগ্নি জ্বলে
সুগন্ধ শোকের সম্মূখীন।
তোমার বিষাদগুলি ওষ্ঠপুটে তুলে নিতে দাও
করতলে রাখি।

আরম্ভের সব কিছু প্রতিশ্রুতিময়।
আরম্ভে সকল গাছই সুসাস্থ্য সবুজ।
আরম্ভে সকল মুখে কলমীলতার ছাঁদে সাদা আলপনা
সব কথা রাখালের বাঁশি
আরম্ভে সকল চোখ চশমা ও কাজল ছাড়া সরল হরিণ।
আরম্ভের সব কিছু প্রতিশ্রুতিময়।
অতিশয় বিচক্ষণ হতে গিয়ে যত কিছু অদল-বদল
চোখে ছানি, গালে ব্রণ, বুকে লোম
নখে রক্তপাত
লালসা ও লোভ
ডুমুর ফলের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ এটেঁ যার দাঁতের মাড়িতে।

অতিরিক্ত লালসায় গাছ দীর্ঘ হয়।
আরও উচু হলে আরও অনেক আকাশ
এই ভেবে জিরাফের গ্রীবা ছুঁড়ে গাছ দীর্ঘ হয়।
বাতাসে হলুদ পাতা বাসী ফুল পতনে মূর্ছায়
স্তুপাকার, জলে-স্থলে শোকধ্বনিময়।

অন্যখানে আরও বেশি ভালোবাসা সোনার সিন্দুকে
এই লোভে শৈশবের রূপকথা রাজপুরী ভাঙে
ডুরে শাড়ী বদলে যায়, বিনুনীতে সাপের গড়ন
ঈর্ষার কাজল চোখে, দাঁতের হাসি ধবল করাত।

যে যতই দূরে যাক
অবশেষে সকলেরই ফিরে আসা স্মৃতির ভিতরে বৃষ্টিপাতে
অনুশোচনায় বালি ঘাঁটাঘাঁটি বালুকাবেলায়।
তোমার বিষাদগুলি করতরে তুলে নিতে দাও
ওষ্ঠপুটে রাখি।

সমস্ত আরম্ভ জুড়ে মানুষের আলুথালু কত ছোটাছুটি
কুসুম-কুড়ানো কত ভোরবেলা, কুসুমের মতন কাঁকরও
পকেটে কত কি ছবি, আয়নাভাঙা, আতশবাজীর ফুলঝুরি
দোলের আবীর, বাঁকা রেকর্ডের গান, আঁচলে কত কি
মনোহর মন্ত্রধ্বনি, পালকি যায় পাখী যেতে পারে যত দূর।

আরম্ভের সব কিছু এইরূপ প্রতিশ্রুতিময়।
ক্রমে,
ভীষণ নীরবে
প্রতিশ্রুতি, গাছ ও মানুষ
একযোগে হরিতাভ হয়।

ক্রমে, ভীষণ নীরবে
চোখের কাজল, বেণী, বিত্রিত আঁচল
সোনার সিন্দুক, সব সতকর্তা, সাফল্যের স্ফীতকায় ঘাড়
স্তম্ভ, দম্ভ, জঙ্ঘা, ঊরু, গর্ব অহংকার
সবকিছু থেকে, চেয়ানো ঘামের মত অদ্ভুত বিষাদ।
অবশেষে বৃষ্টিপাত স্মৃতির ভিতরে
বালুকাবেলায়।
তোমার বিষাদগুলি ওষ্ঠপুটে তুলে নিতে দাও
করতলে রাখি।

সভ্যতা সময় কিংবা মানুষের মহাইতিহাস
এত শোকে তবুও মরেনি।
কারণ মানুষ
এখনো নিজের করতলে
তুলে নেয় অন্যের বিষাদ।
আকাশ পাতাল থেকে এত বিষ, বারুদ ও জীবানু সত্ত্বেও
এখনো মানুষ
অন্য কিছু মহত্তম সুধার আশায়
ওপরের ওষ্ঠ থেকে তার সব মলিন বিষাদ
শুষে নিতে চায়

এখনো বিষাদ পাবে বলে
পুরুষ নারীর কাছে যায়
নারীরা নদীর কাছে যায়
নদীরা মাটির কাছে যায়
মাটি আকাশের দিকে চায়।

তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে চাও
ওষ্ঠপুটে রাখি।

শুক্রবার, ৩ জুলাই, ২০২০

হে সময়, অশ্বারোহী হও – পুর্ণেন্দু পত্রী

বিরক্ত নদীর মতো ভুরু কুঁচকে বসে আছে আমাদের কাল।
যাচ্ছি যাব, যাচ্ছি যাব এই গড়িমসি করে চূড়ো ভাঙা চাকা ভাঙা রথ
যে রকম ঘাড় গুজে ধুলোয় কাতর, সে রকমই শুয়ে বসে আছে।
খেয়াঘাটে পারাপার ভুলে-যাওয়া, নৌকার মতন, সময় এখন।

মনে হয় সময়ের পায়ে ফুটে গেছে দীর্ঘ পেরেক বা মনসার কাঁটা
ছিড়ে গেছে স্ম্যান্ডেলের স্ট্র্যাপ কিংবা জুতোর গোড়ালি
মনে হয় তার সব কোটপ্যান্ট ধোবার ভাটিতে
হয়তো বা কোনও এক লেকা্যাল ট্রেনের হু হু ভিড়ে
চুরি হয়ে গেছে পার্স, পার্সে ছিল অগ্রিম টিকিট।

প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে নিয়ে যাবে পাহাড়ের সোনালী চূড়োয়
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে আকাশের সিথি থেকে সিদুরের টিপ এনে দেবে
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে নক্ষত্রের ক্যামেরায় ছবি তুলে উপহার দেবে অ্যলবাম
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে কলকাতায় এন দেবে শঙ্খের সাগর।

প্রতিশ্রুতি যত্রতত্র ছড়াবার ছিটোবার কথ, থুতু, মলমুত্র নয়
প্রতিশ্রুতি লাল নীল পতাকার ব্যতিব্যস্ত ওড়াউড়ি নয়
প্রতিশ্রুতি প্রেসনোট, দৈববাণী, দেয়ারের লিপিচিত্র নয়।
প্রতিশ্রুতি শীতের চাদর
প্রতিশ্রুতি ভাঙা চালে খড়
প্রতিশ্রুতি সাদা ভাত, ভাতে দুধ, দুধে ঘন সর
প্রতিশ্রুতি চেতনার স্তরে স্তরে সপ্তসিন্ধুজলের মর্মর।

হে সময়, হে বিকলাঙ্গ বিভ্রান্ত সময়
কানা কুকুরের মতো এটো-কাটা ঘাঁটাঘাঁটি ভুলে
পৃথিবীর আয়নায় মুখ রেখে জামা জুতো পরে
সূর্যের বল্লম হাতে, একবার অশ্বারোহী হও।

বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই, ২০২০

পৃথক পাহাড় – হেলাল হাফিজ

আমি আর কতোটুকু পারি ?

কতোটুকু দিলে বলো মনে হবে দিয়েছি তোমায়,
আপাতত তাই নাও যতোটুকু তোমাকে মানায়।

ওইটুকু নিয়ে তুমি বড় হও,
বড় হতে হতে কিছু নত হও
নত হতে হতে হবে পৃথক পাহাড়,
মাটি ও মানুষ পাবে, পেয়ে যাবে ধ্রুপদী আকাশ।

আমি আর কতোটুকু পারি ?
এর বেশি পারেনি মানুষ।

সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৯

আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর ___হুমায়ুন আজাদ

আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো।
তোমার খবরের জন্য যে আমি খুব ব্যাকুল,
তা নয়। তবে ঢাকা খুবই ছোট্ট শহর। কারো কষ্টের
কথা এখানে চাপা থাকে না।

শুনেছি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো।
প্রত্যেক রাতে সেই ঘটনার পর নাকি আমাকে মনে পড়ে
তোমার। পড়বেই তো, পৃথিবীতে সেই ঘটনা
তুমি-আমি মিলেই তো প্রথম সৃষ্টি করেছিলাম।

যে-গাধাটার হাত ধরে তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে সে নাকি এখনো
তোমার একটি ভয়ংকর তিলেরই খবর পায় নি।
ওই ভিসুভিয়াস থেকে কতটা লাভা ওঠে তা তো আমিই প্রথম
আবিষ্কার করেছিলাম। তুমি কি জানো না গাধারা কখনো
অগ্নিগিরিতে চড়ে না?

তোমার কানের লতিতে কতটা বিদ্যূৎ আছে, তা কি তুমি জানতে?
আমিই তো প্রথম জানিয়েছিলাম ওই বিদ্যূতে
দপ ক'রে জ্বলে উঠতে পারে মধ্যরাত।
তুমি কি জানো না গাধারা বিদ্যূৎ সম্পর্কে কোনো
খবরই রাখে না?

আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো।
যে-গাধাটার সাথে তুমি আমাকে ছেড়ে চ'লে গেলে সে নাকি ভাবে
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত শয্যাকক্ষে কোনো শারীরিক তাপের
দরকার পড়ে না। আমি জানি তোমার কতোটা দরকার
শারীরিক তাপ। গাধারা জানে না।

আমিই তো খুঁজে বের করেছিলাম তোমার দুই বাহুমূলে
লুকিয়ে আছে দু'টি ভয়ংকর ত্রিভুজ। সে-খবর
পায় নি গাধাটা। গাধারা চিরকালই শারীরিক ও সব রকম
জ্যামিতিতে খুবই মূর্খ হয়ে থাকে।

তোমার গাধাটা আবার একটু রাবীন্দ্রিক। তুমি যেখানে
নিজের জমিতে চাষার অক্লান্ত নিড়ানো, চাষ, মই পছন্দ করো,
সে নাকি আধ মিনিটের বেশি চষতে পারে না। গাধাটা জানে না
চাষ আর গীতবিতানের মধ্যে দুস্তর পার্থক্য!

তুমি কেনো আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে? ভেবেছিলে গাড়ি, আর
পাঁচতলা ভবন থাকলেই ওষ্ঠ থাকে, আলিঙ্গনের জন্য বাহু থাকে,
আর রাত্রিকে মুখর করার জন্য থাকে সেই
অনবদ্য অর্গান?

শুনেছি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো।
আমি কিন্ত কষ্টে নেই; শুধু তোমার মুখের ছায়া
কেঁপে উঠলে বুক জুড়ে রাতটা জেগেই কাটাই, বেশ লাগে,
সম্ভবত বিশটির মতো সিগারেট বেশি খাই।

মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৯

তৃষ্ণা - হেলাল হাফিজ---যে জলে আগুন জ্বলে

কোনো প্রাপ্তিই পূর্ণ প্রাপ্তি নয়

কোনো প্রাপ্তির দেয় না পূর্ণ তৃপ্তি

সব প্রাপ্তি ও তৃপ্তি লালন করে

গোপনে গহীনে তৃষ্ণা তৃষ্ণা তৃষ্ণা।

আমার তো ছিলো কিছু না কিছু যে প্রাপ্য

আমার তো ছিলো কাম্য স্বল্প তৃপ্তি

অথচ এ পোড়া কপালের ক্যানভাসে

আজন্ম শুধু শুন্য শুন্য শুন্য।

তবে বেঁচে আছি একা নিদারুণ সুখে

অনাবিষ্কৃত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বুকে

অবর্ণনীয় শুশ্রূষাহীন কষ্টে

যায় যায় দিন ক্লান্ত ক্লান্ত ক্লান্ত।

বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

অমিমাংসিত সন্ধি – হেলাল হাফিজ

তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো?
 পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো।
ইচ্ছে হলে দেখতে দিও, দেখো 
 হাত বাড়িয়ে হাত চেয়েছি রাখতে দিও, রেখো
অপূণতায় নষ্টে-কষ্টে গেলো 
 এতোটা কাল, আজকে যদি মাতাল জোয়ার এলো 
এসো দু’জন প্লাবিত হই প্রেমে 
 নিরাভরণ সখ্য হবে যুগল-স্নানে নেমে।
থাকবো ব্যাকুল শর্তবিহীন নত 
 পরস্পরের বুকের কাছে মুগ্ধ অভিভূত।

Ferouz Patowary

It is a personal expression of social media. Expressions are expressed in the context.

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

আমার ব্লগ তালিকা

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

অনুসরণকারী